Home অন্যান্য এলপিজির ঘোষিত দাম বেড়েছে ২৮ শতাংশের বেশি

এলপিজির ঘোষিত দাম বেড়েছে ২৮ শতাংশের বেশি

69
0

ডেস্কঃ আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য, পরিবহনসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় হিসাবের ভিত্তিতে প্রতি মাসেই দেশের বাজারে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) মূল্য নির্ধারণ করা হয়। সর্বশেষ চলতি নভেম্বরের জন্যও এলপিজির ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ৩৮১ টাকা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ মাসে বিইআরসি ঘোষিত এলপিজির দাম বেড়েছে ২৮ শতাংশের বেশি। যদিও বাজার থেকে আরো বেশি দামে কিনতে হয় বলে ভোক্তাদের অভিযোগ।

দেশের বাজারে এলপিজির মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রতি মাসে সৌদি আরামকো কোম্পানির নির্ধারিত প্রোপেন ও বিউটেনের (এলপিজির কাঁচামাল) মূল্যকে অনুসরণ করে বিইআরসি। এর সঙ্গে আমদানিতে জাহাজ ভাড়া, ট্রেডারের প্রিমিয়াম চার্জ, ব্যাংকের এলসি নিষ্পত্তি ও দেশের অভ্যন্তরে খুচরা বাজারের চার্জ হিসাব করে জ্বালানি পণ্যটির দাম ঠিক করা হয়। ডলার থেকে টাকায় রূপান্তরের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয় পূর্ববর্তী মাসের বিনিময় হারকে। কিন্তু টাকার অবমূল্যায়ন ও এলসি খোলায় ডলারের প্রাপ্যতাসংক্রান্ত জটিলতার কারণে কমিশনের এ ফর্মুলা এখন ঠিকমতো কাজ করছে না বলে দাবি এলপিজি অপারেটর ও ব্যবসায়ীদের।

বিইআরসির ঘোষণা অনুযায়ী, দেশে গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ১২ কেজি এলপিজির ঘোষিত বাজারদর ছিল ১ হাজার ৭৪ টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে তা ৯৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সেখান থেকে বাড়তে বাড়তে এখন তা ১ হাজার ৩৮১ টাকায় এসে ঠেকেছে। সে অনুযায়ী চলতি নভেম্বর পর্যন্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে জ্বালানি পণ্যটির বিইআরসি ঘোষিত দাম বেড়েছে ২৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

সারা দেশের বিভিন্ন বাজারে অবশ্য খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কোথাও এখন কমিশন ঘোষিত দামে এলপিজির সিলিন্ডার পাওয়া যাচ্ছে না। নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে সিলিন্ডারপ্রতি ২০০-২৫০ টাকা বেশি দিয়ে গ্রাহককে এলপিজি কিনতে হচ্ছে। খুচরা ও ডিলার পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের দাবি, ব্র্যান্ডভেদে পরিবেশকদের কাছ থেকেই বেশিতে কিনতে হচ্ছে তাদের। কারণ হিসেবে পণ্যের সংকটকেই তারা সামনে আনেন।

বিইআরসি সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের শুরুতে অর্থাৎ জুলাইয়ে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের কমিশন দাম ঘোষণা করে ৯৯৯ টাকা। কিন্তু ওই সময়ে বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিলিন্ডার বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ১০০ থেকে শুরু করে ১ হাজার ২৫০ টাকা পর্যন্ত। আগস্টে কমিশন নির্ধারিত দাম ছিল ১ হাজার ১৪০ টাকা, বাজারে বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ২৫০ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৩৫০ টাকা। সেপ্টেম্বরে ১ হাজার ২৮৪ টাকার সিলিন্ডার বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫২০ টাকা পর্যন্ত। অক্টোবরে ১ হাজার ৩৬৩ টাকা ঘোষিত দাম থাকলেও বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৪৩০ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪৮০ টাকায়। আর চলতি মাসে ঘোষিত দাম ১ হাজার ৩৮৩ টাকা থাকলেও বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪৫০ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত।

রাজধানীর অন্তত তিনটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বসুন্ধরা, বেক্সিমকো, ওমেরা ও জেএমআই এলপিজি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪৫০ টাকায়। এছাড়া পেট্রোম্যাক্স, ইউনাইটেড, ফ্রেশ, বিএম ও ইউরো গ্যাস বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪২০ থেকে শুরু করে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত।

দেশে এলপিজির বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১৪ লাখ টন। এর প্রায় ৯৮ শতাংশই পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে। আর এর ৮০ শতাংশই ব্যবহার হচ্ছে বাসাবাড়িতে। তবে অব্যাহতভাবে মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করেছেন অপারেটররা। আর বিইআরসি নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি না হওয়ার কারণ হিসেবে সরবরাহ চেইনে বাধাগ্রস্ত এবং ডলারের মুদ্রাজনিত বিনিময় হার বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন তারা।

জ্বালানি পণ্যটির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন, এ মুহূর্তে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে ডলার সংকট ও টাকার অবমূল্যায়ন। ডলার সংকটের কারণে পণ্যটি আমদানিতে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। আবার আমদানির পর মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তও হতে হচ্ছে তাদের। বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি আকারের কোম্পানিগুলোকে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হচ্ছে। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কোনো কোনো কোম্পানির পক্ষে এখন ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করাই মুশকিল হয়ে পড়েছে।

চলতি মাসে এলপিজির মূল্য ঘোষণার ক্ষেত্রে বিইআরসি ডলারের বিনিময় হার হিসাব করেছে ১১৩ টাকা ৯২ পয়সা দরে। কিন্তু এলপিজি অপারেটররা বলছেন, ডলারের অভাবে ব্যাংকগুলো এখন এ দরে এলসির দায় পরিশোধ করতে পারছে না। আবার যেসব কোম্পানি এতদিন আমদানির মূল্য পরিশোধের জন্য ডেফার্ড পেমেন্টের ওপর নির্ভর করছিল, তারাই এখন বিপাকে পড়ছে সবচেয়ে বেশি। পরিশোধের সময় প্রতি ডলারের বিপরীতে এলসি খোলার সময়কার তুলনায় অনেক বেশি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে।

অপারেটরদের তথ্য অনুযায়ী, এলপিজি আমদানিতে বেশির ভাগ কোম্পানিকে এখন নগদ টাকায় পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। বিদেশী সরবরাহকারীরাও পণ্য জাহাজে লোড করছে শতভাগ এলসি পেমেন্টের শর্তে। বিনিময়জনিত লোকসান এড়াতে বেশির ভাগ কোম্পানিই ডেফার্ড পেমেন্টে এলপিজি আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। যদিও আগে এলসির দায় পরিশোধে সর্বোচ্চ ১৬০ দিন বা ছয় মাস পর্যন্ত সময় পেতেন অপারেটররা।

বর্তমানে আমদানীকৃত এলপিজির ৮০ শতাংশই ব্যবহার হচ্ছে বাসাবাড়িতে। গত পাঁচ বছরে এ খাতের ব্যবসা দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকার ওপরে। বাজারে এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ২৫-২৬টি কোম্পানি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সামনের দিনগুলোয় এ শিল্প আরো প্রসারিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও বর্তমান পরিস্থিতি পণ্যটির বাজার সম্প্রসারণের পথে বড় প্রতিবন্ধকতা।

বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের হেড অব সেলস মো. রেদোয়ানুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এলপিজি খাতে মোটা দাগে এখন দুটি সমস্যা। প্রথমত, চাহিদা ও সময়মতো ঋণপত্র খুলতে না পারা। দ্বিতীয়ত, এলসি খোলা ও পরিশোধের সময় ডলারের দরে বড় ধরনের পার্থক্য তৈরি হওয়া। এ দুটিই এখন এলপিজি খাতের সম্প্রসারণের পথে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

বর্তমানে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন অব্যাহত থাকায় বিদেশী ব্যাংকগুলো সরবরাহকারীদের পণ্য রফতানির বিষয়ে সতর্কতা দিয়েছে বলে জানান অপারেটররা। যেকোনো দেশে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার ক্ষয় অব্যাহত থাকলে এ ধরনের সতর্কতা দিয়ে থাকে বিদেশী ব্যাংকগুলো।

ওরিয়ন গ্যাস লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) প্রকৌশলী অনুপ কুমার সেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এলসির দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলার রেটের সঙ্গে বড় পার্থক্য তৈরি হচ্ছে। যেখানে এলপিজি কোম্পানিগুলোর বড় লোকসান হচ্ছে। এ সমস্যার দ্রুত সমাধান হওয়া দরকার। এভাবে চলতে থাকলে এলপিজি খাত মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

ডলার সংকটের বিষয়টি অস্বীকার করছেন না ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরাও। এ মুহূর্তে সেই সংকটের সমাধানও দেখছেন না তারা। যারা বৃহৎ আকারে এলসি খুলছেন তাদের ঋণপত্রের জন্য ডলারের সংস্থান নিজেদেরই করার পরামর্শ দিচ্ছেন ব্যাংকাররা। এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডলার সংকটের আগে যে পরিমাণ ঋণপত্র (এলসি) খোলা যেত, এখন তা ৫০-৬০ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে গ্রাহকভেদে ব্যাংকের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here